যাকাত: এক অনন্য দান যা সমাজের উন্নতি নিশ্চিত করে

Mitun
0

যাকাত: ইসলামের এক মহান অনুশীলন এটি নিয়ে আজকের এই পোস্টে বিস্তারিত জানিয়ে দিলাম

যাকাত ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ, যা শুধুমাত্র আর্থিক দান নয়, বরং এটি একজন মুসলিমের আধ্যাত্মিক ও সামাজিক দায়িত্বের প্রতিফলন। "যাকাত" শব্দটি আরবি থেকে এসেছে, যার অর্থ হলো "পবিত্রকরণ" বা "বিশুদ্ধ করা"। এটি ইসলামের পাঁচটি রুকনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা মুসলিমদের জীবনযাত্রায় সদিচ্ছা, দানশীলতা এবং সহানুভূতির মূল্য প্রতিষ্ঠা করে।


যাকাত কী?

যাকাত একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদ যা মুসলিমরা তাদের মালিকানাধীন কিছু সম্পত্তির জন্য প্রতি বছর নির্দিষ্ট নিয়মে দান করেন। এটি দরিদ্রদের, এতিমদের, এবং সমাজের অবহেলিত অংশের সাহায্যে ব্যবহার করা হয়। এটি একটি ধরনের সামাজিক ন্যায্যতা, যেখানে ধনী মানুষ তাদের সম্পদ ক্ষুদ্র একটি অংশ গরীবদের জন্য প্রদান করে, যেন তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয় এবং সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়।


যাকাতের পরিমাণ কীভাবে গণনা করা হয়?

যাকাতের পরিমাণ হলো এক বছর ধরে আপনার মালিকানাধীন সঞ্চিত সম্পদের ২.৫%। তবে, কিছু বিশেষ সম্পদ, যেমন কৃষি ফসল, ব্যবসার মুনাফা, রিয়েল এস্টেট ইত্যাদির জন্য আলাদা গণনা হতে পারে।

যাকাত প্রদানের জন্য যে পরিমাণ সম্পদ থাকতে হবে:

১. নেসাব: যাকাত দেওয়ার জন্য একটি মুসলিমের কাছে "নেসাব" পরিমাণ সম্পদ থাকতে হবে। নেসাব হলো এমন একটি পরিমাণ সম্পদ যার পরিমাণ হলো প্রায় ৫৭০ গ্রাম সোনার সমমূল্য। বর্তমান বাজারদরের ভিত্তিতে, এটি প্রায় ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকার সমান হতে পারে (যদি সোনার দাম ধরুন ৮,০০০ টাকা প্রতি গ্রাম)।

২. অবশিষ্ট সম্পদ: যদি আপনার কাছে সোনার বা রুপোর নেসাব পরিমাণ সম্পদ থাকে, তাহলে আপনাকে ২.৫% পরিমাণ যাকাত দিতে হবে। এর অর্থ, যদি আপনার কাছে ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা বা তার বেশি সম্পদ থাকে, তবে আপনি প্রতি বছর যাকাত হিসেবে ২.৫% দান করবেন, যা প্রায় ১১,২৫০ টাকা হতে পারে।

যাকাতের খাতগুলো কি কি
Zakat


কাদের জন্য যাকাত?

যাকাত প্রদান করা হয় কয়েকটি নির্দিষ্ট শ্রেণীর মানুষের জন্য, যেমন:

  1. দরিদ্র ও অভাবী মানুষ: যারা তাদের জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় মৌলিক প্রয়োজনীয়তাগুলি পূরণ করতে অক্ষম।
  2. এতিম ও বিধবা: যারা একাধারে অর্থনৈতিক এবং সামাজিকভাবে অসহায়।
  3. পথচারী বা যাত্রীরা: যারা দারিদ্র্যের কারণে তাদের যাত্রা চালিয়ে যেতে পারছে না।
  4. ঋণগ্রস্ত মানুষ: যারা অর্থনৈতিকভাবে বিপদগ্রস্ত এবং তাদের ঋণ পরিশোধ করার সামর্থ্য নেই।
  5. ইসলামিক প্রতিষ্ঠান: কিছু ইসলামী প্রতিষ্ঠান যেমন মসজিদ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেগুলি সমাজের কল্যাণে কাজ করে, তাদেরও যাকাত দেওয়া যেতে পারে।

যাকাতের উপকারিতা

  1. আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধি: যাকাত প্রদানের মাধ্যমে একজন মুসলিম নিজের সম্পদকে পবিত্র করে, নিজের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে এবং আল্লাহর কাছে সাওয়াব অর্জন করে।

  2. সামাজিক সাম্য ও ন্যায্যতা: যাকাত ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে সামাজিক ব্যবধান কমিয়ে আনে। এটি এক ধরনের "সম্পদের পুনঃবন্টন" যা সমাজে সামাজিক ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করে।

  3. অর্থনৈতিক উন্নতি: যাকাত দরিদ্রদের মধ্যে অর্থের প্রবাহ সৃষ্টি করে, যা তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করে এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।

  4. প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণ: যাকাত অনেক সময় দরিদ্রদের জীবনযাত্রার নতুন সুযোগ সৃষ্টি করে। এটি তাদের নতুন কাজে যুক্ত হতে এবং নিজেদের উন্নতি করতে সাহায্য করে।


যাকাতের দানে মানবিকতা ও সহানুভূতির প্রসার

যাকাত শুধু একটি আর্থিক দান নয়, বরং এটি একটি মানবিক দায়িত্ব। যখন একজন ধনী ব্যক্তি তার সম্পদ থেকে একটি অংশ দরিদ্রদের সাহায্যে প্রদান করেন, তখন তিনি সমাজের প্রতি দায়িত্বশীলতা অনুভব করেন। এটি শুধু দরিদ্রদের সাহায্যই নয়, বরং পুরো সমাজের মধ্যে সহানুভূতি ও মানবিকতার গঠন করে।


১ লাখ টাকায় যাকাত কত

১ লাখ টাকায় যাকাত হবে:

যাকাতের পরিমাণ ২.৫%। তাই ১,০০,০০০ টাকার উপর যাকাত হিসাব করলে:

যাকাত = ২.৫% × ১,০০,০০০ = ২,৫০০ টাকা

অতএব, ১ লাখ টাকায় যাকাত হবে ২,৫০০ টাকা


বর্তমানে কত টাকা থাকলে যাকাত ফরজ হয়

বর্তমানে যাকাত ফরজ হওয়ার জন্য একটি মুসলিমের কাছে নেসাব পরিমাণ সম্পদ থাকতে হবে। নেসাব হলো এমন পরিমাণ সম্পদ, যা সোনার অথবা রূপোর মানের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়।

সোনার নেসাবের পরিমাণ হচ্ছে প্রায় ৫৭০ গ্রাম সোনা (যার মূল্য বর্তমান বাজারদরে প্রায় ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকার কাছাকাছি) অথবা ৭৫০ গ্রাম রূপা। যদি আপনার কাছে এই পরিমাণ সম্পদ থাকে, তবে আপনার ওপর যাকাত ফরজ হবে।

তবে, নেসাবের পরিমাণ পরিবর্তিত হতে পারে সোনার দাম অনুযায়ী। উদাহরণস্বরূপ, যদি সোনার দাম ৮,০০০ টাকা প্রতি গ্রাম ধরা হয়, তাহলে:

৫৭০ গ্রাম সোনার মূল্য = ৫৭০ × ৮,০০০ = ৪,৫৬,০০০ টাকা (প্রায় ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকার মতো)

অতএব, যদি আপনার হাতে ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকার সমপরিমাণ সোনা বা রূপো বা অন্যান্য সম্পদ থাকে, তবে আপনাকে যাকাত দিতে হবে।


যাকাত ফরজ হওয়ার শর্ত কয়টি

যাকাত ফরজ হওয়ার জন্য কিছু শর্ত রয়েছে। সেগুলি হলো:


১. ইসলামিক ধর্মাবলম্বী হওয়া:

যাকাত ফরজ হওয়ার জন্য একজন ব্যক্তিকে মুসলিম হতে হবে। কারণ যাকাত ইসলাম ধর্মের একটি মূল রুকন (স্তম্ভ), এবং এটি কেবল মুসলিমদের জন্য ফরজ।


২. বালিগ হওয়া (প্রাপ্ত বয়স্ক):

যাকাত ফরজ হতে একজন মুসলিমের বয়স বালিগ (প্রাপ্ত বয়স্ক) হতে হবে। এটি সাধারণত পুরুষদের জন্য ১৫ বছর এবং মেয়েদের জন্য তাদের হায়েজ (মেনস্ট্রুয়েশন) শুরু হওয়ার পর থেকে গণনা করা হয়।


৩. সম্পদের পরিমাণ (নেসাব):

একজন মুসলিমের কাছে যাকাত ফরজ হওয়ার জন্য তার নেসাব পরিমাণ সম্পদ থাকতে হবে। নেসাব হলো এমন একটি সম্পদের পরিমাণ, যা সোনা বা রূপোর মূল্য নির্ধারণের ভিত্তিতে প্রায় ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকার সমপরিমাণ (সোনার ক্ষেত্রে প্রায় ৫৭০ গ্রাম) হতে হবে। যদি আপনার হাতে এই পরিমাণ সম্পদ থাকে এবং তা এক বছর ধরে থাকে, তবে আপনার ওপর যাকাত ফরজ হবে।


৪. সম্পদ এক বছর থাকা (হাওলানুল হাওয়াল):

আপনার সম্পদ এক বছরের বেশি সময় ধরে হাতে থাকতে হবে। অর্থাৎ, যাকাত দেওয়ার সময় যদি আপনার সম্পদ এক বছর ধরে সঞ্চিত থাকে, তাহলে তা যাকাত দেওয়ার উপযুক্ত হবে। যদি সম্পদ এক বছরের জন্য স্থিতিশীল না থাকে (যেমন কিছু সম্পদ বিক্রি বা খরচ হয়ে গেছে), তবে সে ক্ষেত্রে যাকাত ফরজ হবে না।


৫. ব্যক্তিগত মালিকানা:

আপনার যাকাত প্রদানের যোগ্য সম্পদ আপনার ব্যক্তিগত মালিকানাধীন হতে হবে। যদি আপনার সম্পদ অন্য কারও অধীনে থাকে (যেমন ঋণ, অন্যের কাছে জামানত হিসেবে রাখা), তবে তা যাকাত দেওয়ার জন্য উপযুক্ত হবে না।


৬. ঋণমুক্ত থাকা:

যদি আপনার উপর কোনো ঋণ থাকে, তাহলে আপনার সম্পদের পরিমাণ ঋণ পরিশোধের পর যাকাত নির্ধারণ করা হবে। অর্থাৎ, যদি আপনি ঋণগ্রস্ত হন, তবে ঋণের পরিমাণ বাদ দিয়ে যাকাত হিসাব করতে হবে।


এই শর্তগুলো পূর্ণ হলে, তখন আপনার ওপর যাকাত ফরজ হবে।


যাকাতের খাতগুলো কি কি

যাকাতের ৮টি খাত (যাকাত দেওয়ার প্রাপ্য শ্রেণী) ইসলামের শাস্ত্রে বর্ণিত হয়েছে, যা কুরআন এবং হাদীসে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন:

"যাকাত কেবল ৮টি খাতে দান করা যাবে।"
(সূরা আত-তাওবা, আয়াত ৬০)

এই ৮টি খাত হলো:


১. ফকির (দরিদ্র):

ফকির হলো এমন ব্যক্তি, যিনি জীবিকার জন্য প্রয়োজনীয় মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে অক্ষম। তার কাছে পর্যাপ্ত সম্পদ নেই, যাতে সে নিজের জীবনধারণ করতে পারে। যাকাত দিয়ে তাকে সাহায্য করা হয়।

২. মিসকীন (অভাবী):

মিসকীন হলো সেই ব্যক্তি, যিনি সচ্ছল না, কিন্তু তার অবস্থা এতটা খারাপও নয় যে তাকে ফকিরের মতো কঠিন অবস্থায় পড়তে হয়। তিনি দিন-প্রতিদিনের প্রয়োজন মেটাতে অক্ষম এবং যাকাত তার জন্যও প্রদান করা যায়।


৩. যাকাতের কর্মী:

এটি হলো সেই ব্যক্তি বা সংস্থা যারা যাকাত সংগ্রহ ও বিতরণ কাজের সঙ্গে যুক্ত। তাদেরও যাকাত দেওয়ার অনুমতি রয়েছে, যাতে তারা তাদের কাজ চালিয়ে যেতে পারে।


৪. যোদ্ধা (মুজাহিদ):

মুজাহিদ হলো আল্লাহর পথে যুদ্ধকারী। যেহেতু তারা যুদ্ধের কারণে অর্থ উপার্জনের সুযোগ পায় না, তাদেরও যাকাত দেওয়া যেতে পারে, যাতে তারা যুদ্ধের কাজে নিয়োজিত থাকতে পারে।


৫. নতুন মুসলিম:

যারা ইসলাম গ্রহণ করেছেন, তাদের জন্যও যাকাত দেওয়া যেতে পারে, বিশেষত যদি তারা আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে থাকেন এবং ইসলাম গ্রহণের পর নতুন জীবন শুরু করতে চান।


৬. ঋণগ্রস্ত (দেনাদার):

এটি হলো সেই ব্যক্তি, যিনি অত্যধিক ঋণের কারণে তার দীন ও জীবনধারণে সংকটে আছেন। যাকাতের মাধ্যমে তাদের ঋণ পরিশোধ করতে সাহায্য করা যেতে পারে।


৭. পথচারি (সাফরী):

পথচারি হলো সেই ব্যক্তি, যিনি তার যাত্রাপথে অর্থাভাব বা বিপদে পড়েছেন। তাকে যাকাত দেওয়া যেতে পারে, যদি সে তার মূল জায়গা থেকে দূরে থাকেন এবং তার কাছে পর্যাপ্ত অর্থ না থাকে।


৮. আল্লাহর রাস্তায় (ফি সাবোলিল্লাহ):

এই খাতে যাকাত দেওয়া হয় ইসলামি কাজ, শিক্ষা, গবেষণা বা সমাজের কল্যাণে ব্যবহারের জন্য। আল্লাহর রাস্তায় যাকাত দেওয়া মানে হলো যে কোনো কার্যক্রম, যা ইসলামের খেদমতে বা মানবতার সেবায় কাজে লাগবে।


এই ৮টি খাতের মাধ্যমে যাকাত বিতরণ করা যায়, এবং এটি সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের সহায়তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।


উপসংহার:

যাকাত ইসলামের একটি অনন্য দান, যা শুধুমাত্র আর্থিক নয়, বরং আধ্যাত্মিক, সামাজিক এবং মানবিক পরিপূর্ণতা অর্জন করতে সহায়তা করে। এটি একদিকে যেমন ইসলামী মূল্যবোধের প্রতিষ্ঠা ঘটায়, তেমনি সমাজের মধ্যে এক শক্তিশালী সংহতি গড়ে তোলে। আমরা সবাই যদি আমাদের মালিকানাধীন সম্পদের একটি অংশ যাকাত হিসেবে দেই, তাহলে আমরা সমাজে দারিদ্র্য দূরীকরণে এবং মানবতার উন্নতিতে সাহায্য করতে পারব।

Post a Comment

0Comments

Post a Comment (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!